শর্টস পরে খেলার কারণে মারধর : এসিড নিক্ষেপের হুমকি
০২ অগাস্ট ২০২৩, ২১:১৫ পিএম
বটিয়াঘাটায় চার নারী ফুটবলারকে মারধরের ঘটনায় করা মামলা তুলে না নিলে তাঁদের ওপর এসিড ছোড়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। হুমকির ঘটনায় মামলার বাদী ও ভুক্তভোগী নারী ফুটবলার সাদিয়া নাসরিন থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। আসামিদের হুমকিতে নারী ফুটবলাররা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
তাদের একমাত্র 'অপরাধ' ছিল আর দশজন ফুটবল খেলোয়াড়ের মতো তারাও ফুটবল খেলার পোশাক (শর্টস) পরে ফুটবল অনুশীলন করতেন। কেবল এ কারণেই তাদেরকে হেনস্তা ও কটুক্তি করা হতো। সেসবের মৌখিক প্রতিবাদ করায় তাদের হামলা হয়।
সাদিয়া নাসরিন বলেন, ‘আমাকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে। তা না হলে আমাকে ও একাডেমির টিম মেম্বারদের শরীরে অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হবে বলে হুমকি দেয়। এ ছাড়া তাঁরা নিজেরা নিজেদের ক্ষতি করে আমাকেসহ আমার টিমের সদস্যদের পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করবে বলেও হুমকি দিয়েছে। এরপর তারা গালিগালাজ করে চলে যায়। আমি সোমবারই থানায় জিডি করেছি। এ ঘটনায় আমরা সবাই উদ্বিগ্ন।’
গত শনিবার খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়নের তেঁতুলতলা গ্রামে চারজন নারী ফুটবলারকে মারধরের ঘটনা ঘটে। ওই গ্রামের বাসিন্দা বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলের ফুটবলার সাদিয়ার খেলার কিছু ছবি তুলে অপদস্থ করেন নূপুর খাতুন (২২) নামের এক তরুণী।
এ ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নূপুরের বাড়িতে মারধরের শিকার হন সাদিয়া ও তাঁর সহযোগী তিন নারী ফুটবলার। অন্য তিনজন হলেন মঙ্গলী বাগচী, হাজেরা খাতুন ও জুঁই মণ্ডল। এর মধ্যে মঙ্গলী বেশি আঘাত প্রাপ্ত হন। তিনি এখনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন। চার কিশোরীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আহত হন মঙ্গলী বাগচী।
মঙ্গলী বলেন, 'আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরলে দেখি চেয়ারের সঙ্গে আমার হাত বাঁধা।' 'হামলাকারীরা বলে, আমাদের কোনো লজ্জা-শরম নেই এবং মেয়ে হয়ে হাফপ্যান্ট পরে ফুটবল খেললে গ্রাম থেকে বের করে দেবে,' বলেন মঙ্গলী। হামলাকারীরা তাকে সাম্প্রদায়িক কটূক্তি করেছিল বলেও জানান তিনি।
এ ঘটনায় সাদিয়া বাদী হয়ে বটিয়াঘাটা থানায় মামলা করেন। সাদিয়ার করা মামলার আসামিরা হলেন নূপুর খাতুন, আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন, নূর আলম, রঞ্জি বেগম ও মনোয়ারা বেগম। এর মধ্যে ৪ নম্বর আসামি নূর আলমকে পুলিশ গেপ্তার করেছে। এর পর থেকে হামলাকারী ও তাঁর সহযোগীরা নারী ফুটবলারদের শায়েস্তা করা ও এসিড ছোঁড়ার হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন মঙ্গলী বাগচী বলেন, ‘আমি ও আমার পরিবার ভীতসন্ত্রস্ত। তারা (আসামিরা) আমাদের ক্রমাগত শাসিয়ে চলেছে। ঘটনার দিন নূপুরের কাছে আজেবাজে কথা বলার কারণ জানতে চাওয়ায় তারা আমাদের মারধর করে। আমাকে আটকে রেখে পেটায়। মাথা ফাটিয়ে দেয়। এর বিচার চাওয়ায় এখন আবারও শায়েস্তা করার হুমকি দিচ্ছে।’
মঙ্গলীর মা সুচিত্রা বাগচী বলেন, ‘মেয়েদের ফুটবল খেলা তারা পছন্দ করে না। তাই মারধর করেছে। এ ঘটনায় মামলা কেন করা হলো, এখন তাই আবার হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। মেয়েটাকে নিয়ে বাড়িতে যেতেও ভয় পাচ্ছি।’
তেঁতুলতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সুপার কুইন ফুটবল একাডেমির প্রশিক্ষক দেবাশীষ কুমার মণ্ডল বলেন, ‘সাদিয়াসহ এই খেলোয়াড়রা অনেকে বঙ্গমাতা ফুটবল টিমের সদস্য। এরা ছাড়াও অনেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে, কিন্তু সামাজিক বাধার কারণে ফুটবল খেলা চালিয়ে যেতে পারে না। মেয়েরা ফুটবল খেলুক, তা এখানকার একটি অংশ চায় না।’
সাদিয়া নাসরিন বলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে আমরা সামাজিকভাবে কটূক্তির শিকার হয়ে আসছি। তবে ফুটবলের প্রতি ভালবাসার জন্য খেলা বা অনুশীলন ছাড়িনি।
কান্নারত মঙ্গলী বাগচী বলেন, 'অতীতে ফুটবল খেলা নিয়ে অনেক কটূক্তির শিকার হয়েছি। এবার আহত করা হলো। হত্যার হুমকিও দেওয়া হলো। তবে আমি খেলা ছেড়ে দেব না। যতই বাধা আসুক, ফুটবলের সঙ্গে থাকব।'
এদিকে নারী ফুটবলারদের মারধরের ঘটনায় তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। বুধবার সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিতের পাশাপাশি নারীদের প্রতি বৈষম্য ও বিদ্বেষমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিহত করতে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণসহ সামাজিক সচেতনতা তৈরি ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
বটিয়াঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শওকত কবির বলেন, 'আমরা মামলার মূল আসামীকে গ্রেফতার করেছি। এছাড়া ফুটবলার সাদিয়া হুমকি ও নিরাপত্তার কথা বলে থানায় জিডি করেছেন। আমি গতকাল বিকেলে ঘটনাস্থল এবং ঐ এলাকা পরিদর্শন করেছি। নারী ফুটবলারেরা নির্বিঘ্নে প্রশিক্ষণ নেবে। তাদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে পুলিশ।'