ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের সিদ্ধান্ত

Anweshan Desk

Anweshan Desk

০৮ অগাস্ট ২০২৩, ১৩:৪৬ পিএম


ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের সিদ্ধান্ত

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন

বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন করে নতুন আইন করার সিদ্ধান্ত মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়েছে।

সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন করার পর তা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়। তবে এই আইনটিও পড়ে বিতর্কে। প্রচুর লেখক, সাংবাদিক এবং অনলাইন একটিভিস্টদের গ্রেপ্তার করা হয় এই আইনে। ফলে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগের পর জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও আইনটি স্থগিতের আহ্বান আসে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার ৭ আগস্ট সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে নতুন আইনের খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এসময় আগের আইনটি বাতিল বলেও জানানো হয়।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন করে সন্নিবেশিত হবে সাইবার নিরাপত্তা আইনে।

তবে সাইবার নিরাপত্তার জন্য যেসব ধারাগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ছিল, সেগুলো এখানে অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। সেইগুলোর কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। শুধু বাকস্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক আইনগুলো সংশোধিত হচ্ছে।

গত পাঁচ বছরে এই আইনে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলার সংখ্যা ৭ হাজার ১টি বলে সম্প্রতি আইনমন্ত্রী সংসদে জানিয়েছিলেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হলে সেই মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে এটর্নি জেনারেল জানান, 'যখন কোনো আইন বাতিল বা পরিবর্তন করা হয়, সেখানে একটা সেভিং ক্লজ দেওয়া হয়। জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট অনুযায়ী যে মামলাগুলো চলমান, সে মামলাগুলোর ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, এই আইনটা বিলুপ্ত হয় নাই।'

আগে পরিবর্তন করা বিভিন্ন আইন সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন পর্যন্ত যত আইন বাতিল বা পরিবর্তন করা হয়েছে, সবগুলোর ক্ষেত্রে একই অবস্থা হয়েছে। পূর্বের মামলাগুলো আগের মতোই চলবে।

 

যেসব ধারা সংশোধন করা হচ্ছে :

মানহানি

মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থাকা কারদণ্ডের বিধান বাতিল করে নতুন আইনে শুধু জরিমানার বিধান করা হচ্ছে। মানহানির মামলায় দণ্ডিত হয়ে কেউ জরিমানার অর্থ পরিশোধ না করতে পারলে তখন ৩ থেকে ৬ মাসের কারদণ্ড দেওয়া যাবে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৯ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, সেজন্য অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ডে, বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

যদি কোনো ব্যক্তি ওই অপরাধ দ্বিতীয় বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এ ধারায় কী পরিবর্তন আসছে তা জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, “২৯ ধারা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। শুধু শাস্তি হবে জরিমানা, সেই জরিমানা অনাদায়ে ৩ থেকে ৬ মাসের কারাদণ্ড থাকবে। সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে।

'কারাদণ্ড উঠিয়ে দিয়ে শুধু সাজা রাখা হয়েছে। দেওয়ানী আইনে যদি মানুষ ক্ষতিপূরণ চায় সেখানে কিন্তু ক্ষতিপূরণের কোনো লিমিট নেই। ১০০ কোটি টাকাও ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। সেইসব ক্যালকুলেশনে অনধিক ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। সর্বনিম্ন যে কোনো পরিমাণ জরিমানা করা যাবে। এক টাকাও জরিমানা করা যাবে কিন্তু ২৫ লাখ এক টাকা জরিমানা করা যাবে না।'

 

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় সাজা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড থেকে কমিয়ে নতুন আইনে দুই বছর করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী।

২৮ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি দেওয়ার অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে।

এই অপরাধে তাকে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।

যদি কোনো ব্যক্তি ওই অপরাধ দ্বিতীয় বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহলে তিনি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আইনমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই ধারাটি জামিন অযোগ্য ছিল, নতুন আইনে সেটি জামিনযোগ্য করা হচ্ছে।

 

দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করা

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ২১ ধারায় বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচার চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ডে, বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এ অপরাধ দ্বিতীয় বার বা বারবার করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আইনমন্ত্রী জানান, নতুন আইনে এ ধারার সর্বোচ্চ সাজা ১০ বছর থেকে কমিয়ে সাত বছর করা হচ্ছে।

 

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন বা করান, যা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের মধ্যে শত্রুতা, ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বা অস্থিরতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অথবা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায় বা ঘটানোর উপক্রম হয়, তাহলে অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ডে, বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

দ্বিতীয় বার বা বারবার এ অপরাধ করলে অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড, বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

৩১ ধারাতেও পরিবর্তন আনা হয়েছে জানিয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, এই ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ৭ বছর থেকে কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে বাড়তি সাজার বিধানও বাতিল করা হয়েছে।

 

সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ করেন, তাহলে তার অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড, বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে, বা উভয় দণ্ড হবে।

 

এ অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

 

আইনমন্ত্রী বলেন, এই ধারার সর্বোচ্চ সাজা ১৪ বছর থেকে কমিয়ে নতুন আইনে সাত বছর করা হয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা বাড়ার বিধান বাতিল করা হয়েছে।

মানবাধিকার থেকে আরও


Link copied