আফগানিস্তানে আত্মহত্যার চিন্তা মহামারী আকার ধারণ করেছে
০৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ পিএম
‘‘আমি শুধু চাই কেউ আমার কথা শুনুক। আমি ভয়াবহ কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এবং আমিই একমাত্র নই।”
চোখের জলে ভেসে আফগানিস্তানের এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এভাবেই বিবিসি-র সঙ্গে কথা বলেন।
তার কথায়, ‘‘আমার ক্লাসের বেশিরভাগ মেয়ে আত্মহত্যার কথা ভাবছে। আমরা সবাই বিষন্নতা ও হতাশায় ভুগছি। আমাদের কোনও আশা নেই।”
সবে ২০ বছরের কোটা পার করা এই তরুণী চারমাস আগে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এখন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তালেবান পুনরায় আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর গত বছর ডিসেম্বর থেকে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। বিবিসি-কে বলা ওই তরুণীর এই কথাগুলো আফগানিস্তানে এখনও প্রায় অদৃশ্য এক ভয়াবহ মানসিক সংকটকে প্রতি অন্তর্দৃষ্টি দেওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আমাল বলেন, ‘‘আফগানিস্তানে আত্মহত্যার চিন্তা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এতটা খারাপ অতীতে কখনো ছিল না এবং বিশ্ব এটা নিয়ে একদমই ভাবছে না বা কথা বলছে না।
‘‘যখন আপনি নিউজ পড়েন তখন আপনি খাদ্য সংকটের খবর পড়েন, কিন্তু কেউ মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলছে না। এটা অনেকটা জনগণকে ধীরে ধীরে বিষ দেওয়ার মত। দিন দিন তারা তাদের আশা হারিয়ে ফেলছে।”
এই চিকিৎসক জানান, তালেবান বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের দুইদিনের মধ্যে তিনি সাহায্য চেয়ে ১৭০টি ফোন পেয়েছেন। এখনও তিনি প্রতিদিন নতুন করে সাত থেকে ১০টি ফোন পান। ফোনে তার কাছে সাহায্য চাওয়া হয়।
আফগানিস্তানের সমাজ ব্যবস্থা গভীরভাবে পুরুষতান্ত্রিক। প্রায় চার দশক ধরে চলা যুদ্ধ সেখানকার বাসিন্দাদের গভীর মানসিক বিপর্যয়ের দিকে ঠিলে দিয়েছে।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেখানে প্রতি দুই জনে একজন- যাদের অধিকাংশই নারী, মানসিক হতাশায় ভুগছেন। এমনকি ২০২১ সালে তালেবান পুনরায় দেশটির ক্ষমতা দখলের আগে থেকেই পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছিল।
বিশেষজ্ঞরা বিবিসিকে বলেন, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির মত খারাপ অবস্থা অতীতে কখনও ছিল না। কারণ, তালেবান সরকার নারী স্বাধীনতাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছে। সঙ্গে দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট পুরো দেশকে খাদের কিনারে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে।
আফগানিস্তানের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় আত্মহত্যা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা কঠিন। তারপরও ছয়টি পরিবার বিবিসির সঙ্গে তাদের জীবনের গল্প শেয়ার করতে রাজি হয়।
নাদির তাদের একজন। তিনি বলেন, এ বছর মার্চে স্কুলে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর প্রথমদিনই তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে।
‘‘সেদিন পর্যন্তও তার বিশ্বাস ছিল স্কুল ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই খুলবে। সে এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু তেমনটা যখন ঘটলো না, সে সেটা মেনে নিতে পারেনি এবং নিজের জীবন নিয়ে নেয়।
‘‘সে স্কুল খুব ভালোবাসতো। সে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত, চিন্তাশীল ছিল এবং লেখাপড়া করে দেশের জন্য কিছু করতে চাইতো। যখন তারা স্কুল বন্ধ করে দিলো সে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল, সারাদিন কান্নাকাটি করত।”
নাদির যখন তার মেয়েকে নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল তার কতটা কষ্ট হচ্ছে।
‘‘আমাদের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন আমার কাছে আর কোনো কিছুর কোনো অর্থ নেই। নিজেকে এতটা ছোট আর কখনো মনে হয়নি। আমার স্ত্রীও খুবই ভেঙে পড়েছে। যে বাড়িতে আমাদের মেয়ে মারা গেছে সেই বাড়িতে থাকার কষ্ট সে আর বহন করতে পারছে না।”
২০ বছরের আরেক তরুণীর বাবা বিবিসি-কে বলেন, তার বিশ্বাস তার মেয়ের আত্মহত্যার পেছনে কারণ ছিল। ‘‘সে চিকিৎসক হতে চাইত। যখন স্কুল বন্ধ হয়ে গেল, তখনই সে বিপর্যস্ত এবং হতাশ হয়ে পড়েছিল।
‘‘কিন্তু এরপর যখন তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হল না, তখন তার সব আশাই শেষ হয়ে যায়।” ‘হারানোর এ কষ্ট বুকে নিয়ে চলা সম্ভব না’ বলতে বলতে থমকে যাওয়া এই বাবা কাঁদতে শুরু করেন।
বাকি গল্পগুলোও একই রকম। কিশোরী ও তরুণীরা তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
বিবিসি একজন নারী শিক্ষকের সঙ্গেও কথা বলেছেন। নাম মেহের, যিনি নিজে দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন।
তিনি বলেন, ‘‘তালেবান নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিলে, আমিও চাকরি হারাই। আমিই আমার পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলাম। এবং এখন আমি পরিবারের খরচ বহন করতে পারছি না। যার প্রভাব আমার উপর মারাত্মকভাবে পড়েছে।
‘‘যেহেতু আমি ঘরে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। আমাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। আমি নিজের ভবিষ্যতের জন্য যা সব পরিকল্পনা করেছিলাম সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আমি পুরোপুরি দিশেহারা বোধ করছি, কোনো লক্ষ্য নেই, কোনো আশা নেই এবং এই কারণেই আমি আমার জীবন শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম “
বিবিসি আফগান নারীদের মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। কারণ, সম্প্রতি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে দেশ জুড়ে নারীদের আত্মহত্যার খবরের বন্যা বইছে।
আফগানিস্তানের একটি সরকারি হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শান বলেন, ‘‘পরিস্থিতি বিপর্যয়কর এবং সংকটজনক। কিন্তু আমাদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান রাখার বা তা মূল্যায়ন করে দেখার অনুমতি নেই। আমি অবশ্যই বলতে পারি যে, আপনি এখানে এমন কাউকে বলতে গেলে খুঁজেই পাবেন না যিনি মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন না।”
আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশে করা আফগানিস্তান সেন্টার ফর এপিডেমিওলজিকাল স্টাডিজের একটি গবেষণা প্রতিবেদন এ বছর মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়। যেখানে দেখা যায়, আফগান কিশোর-কিশোরীদের দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে।
জাতিসংঘ ‘বিস্তৃত মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং আত্মহত্যার ক্রমবর্ধমান সংখ্যা’ নিয়ে একটি সতর্কবার্তা জারি করেছে।
আর তালেবান বলছে, তারা আত্মহত্যার সংখ্যার রেকর্ড রাখছে না। এই সংখ্যা বাড়ার প্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা জবাব দেয়নি।
যেহেতু সমাজে আত্মহত্যাকে একধরনের কলঙ্ক হিসেবে দেখা হয় তাই বেশিরভাগ পরিবার আত্মহত্যার খবর প্রকাশই করতে চায় না।
পর্যালোচনা করার মত কোনো তথ্য নেই বিধায় বিবিসি বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টির মাত্রা পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে।
চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকা এক কিশোরী বিবিসি-কে বলেন, ‘‘কোনো ধরনের লেখাপড়া ছাড়া, ভবিষ্যৎ ছাড়া বাড়িতে বসে থাকা, এটা আমাকে জঘন্য অনুভূতি দেয়। আমি খুবই ক্লান্ত বোধ করি। কোনো কিছু ভালো লাগে না। এটা অনেকটা কোনো কিছুতেই আর কিছু এসে যাবে না এর মত।”
এই কিশোরীও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। চিকিৎসক এবং তার মায়ের উপস্থিতিতে বিবিসি এই কিশোরীর সঙ্গে কথা বলে। কিশোরীর মা তাকে নিয়ে এতটাই উদ্বিগ্ন থাকে যে মেয়েকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল করে না।
বিবিসি তাদের জিজ্ঞাসা করেছিল কেন তারা বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে চায়? জবাবে মেয়েটি বলে, ‘‘যা ঘটছে তার থেকে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। এ কারণে আমি কথা বলতে চাই।
‘‘এবং আমি মনে করি, হয়ত যদি আমি কথা বলি, কিছুটা হলেও পরিবর্তন আসবে। যদি তালেবানই ক্ষমতায় থেকে যায় তবে আমার মনে হয় তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। যদি তাই হয় তবে আমার বিশ্বাস তারা পুনরায় স্কুল খুলে দেবে।”
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আমাল বলেন, যখন নারীদের উপর কঠিন আঘাত হানা হয় তখন তার প্রভাব পুরুষদের উপরও পড়ে। তিনি বলেন, ‘‘আফগানিস্তানে একজন পুরুষ হিসেবে, আপনি এই বিশ্বাস নিয়ে বড় হবেন যে আপনাকে শক্তিশালী হতেই হবে।
‘‘কিন্তু এই মুহূর্তে আফগান পুরুষরাও তাদের কথা বলতে পারছেন না। অর্থিকভাবে তারা তাদের পরিবারে অবদান রাখতে পারছেন না। এটা সত্যি তাদের উপর প্রভাব ফেলছে।
‘‘এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পুরুষরা যখন আত্মহত্যার কথা ভাবছে, তারা সে কাজে নারীদের চেয়ে বেশি সফল হচ্ছে। কারণ তাদের আত্মহত্যার পরিকল্পনায় ফাঁক থাকছে না।”
এমন পরিস্থিতিতে তিনি তার রোগীদের কি পরামর্শ দেন জানতে চাইলে ডা. আমাল বলেন, ‘‘অন্যাদের বা নিজেকে সাহায্য করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে না ফেলা। আপনি বাইরে যান, বন্ধুর সঙ্গে কথা বলুন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করুন। নিজের জন্য একটি সমর্থক দল গড়ে তুলুন। যে দলে থাকবে আপনার মা-বাবা-ভাইবোন ও বন্ধুরা।
‘আমি রোগীদের জিজ্ঞাসা করি কে তার রোল মডেল। উদাহরণ হিসেবে আমি তাদের নেলসন ম্যান্ডেলার কথা বলি। তার জীবনকে দেখতে বলি, যিনি ২৬ বছর কারাগারের অন্ধকারে কাটিয়েছেন। কিন্তু নিজের মূল্যবোধের কারণে, তিনি বেঁচে থেকেছেন এবং জনগণের জন্য কিছু করেছেন। এভাবেই আমি তাদের আশা এবং বেঁচে থাকার প্রেরণা দেওয়ার চেষ্টা করি।”