সমাবেশে আসা বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশের রাতভর অভিযান : ৫ শতাধিক গ্রেফতার
২৮ জুলাই ২০২৩, ১৩:০৪ পিএম
রাজধানীর নয়াপল্টনের হোটেল মিডওয়ে ইন্টারন্যাশনালের অভ্যর্থনা কক্ষে সারি করে রাখা হয়েছে ছোট-বড় ট্রাভেল ব্যাগ। এর ওপর কাগজের ট্যাগে ব্যাগের মালিক ও তাঁর কক্ষ নম্বর লেখা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে মিডওয়েতে গিয়ে দেখা যায়, মালিকহীন ৫০-৬০টি ব্যাগে ট্যাগ বাঁধা। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, বুধবার মধ্যরাতে সেখানে ধরপাকড় চালানো হয়। যাদের ধরে নেওয়া হয়েছে, তারা বিএনপির সমাবেশে যোগ দিতে এসে ওই হোটেলে উঠেছিলেন। পুলিশ গ্রেপ্তার করে নেওয়ার পর তাদের রেখে যাওয়া ব্যাগ ও মালপত্রে নাম-পরিচয় মিলিয়ে ট্যাগ লাগিয়ে রাখে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
বিএনপির দাবি, মিডওয়ে ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘিরে হঠাৎ পুরোনো ও নতুন ‘গায়েবি মামলায়’ গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অন্যদিকে পুলিশের ভাষ্য, সুনির্দিষ্ট মামলা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বুধবার রাতে ৪৮২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের মধ্যে বিএনপির ৩৬৬ জন। আগের দিন গ্রেপ্তার করা হয় ৭৫ জনকে।
মহাসমাবেশের আগেই দু’দিনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিএনপির পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীকে। তাদের মধ্যে ৪৮২ নেতাকর্মীকে গতকাল কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকা থেকেও বিএনপি নেতাকর্মীর গ্রেপ্তার হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তল্লাশি চালানো হয় ঢাকামুখী যানবাহনেও। রাজধানীর প্রবেশপথে গতকাল রাত থেকে তল্লাশি জোরদার করা হয়।
আওয়ামী লীগের তিন ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ও বিএনপির ঢাকায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির ভেন্যু নিয়ে দু’দিন নানা নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। আবার একপক্ষ অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিলে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। এমন বাস্তবতায় কঠোর অবস্থানে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দু’দিন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ধরপাকড় শুরু করে পুলিশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য, বেশ কিছুদিন ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের রাজপথে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি হলেও বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। তবে দুই দলের কর্মসূচি ঘিরে হঠাৎ রাজধানীজুড়ে পুলিশি তৎপরতা ও শত শত গ্রেপ্তারের ঘটনাকে কেউ কেউ রাজনৈতিক দৃশ্যপটের নতুন মোড় বলে মনে করছেন। চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে বিভেদরেখা আরও স্পষ্ট হওয়ার শঙ্কা কারও কারও।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বলেন, বিএনপিসহ একটি অশুভ রাজনৈতিক শক্তি দেশে নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টির জন্য ষড়যন্ত্র করে আসছে। তারা আন্দোলন ও সমাবেশের নামে জ্বালাও-পোড়াও, গাড়ি ভাঙচুর ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সংঘটিত করে থাকে। এটাই দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন তাদের জায়গা থেকে দৃষ্টি রাখবে, আমরাও রাজনৈতিকভাবে এগুলো মোকাবিলার পাশাপাশি সন্ত্রাস-নৈরাজ্যের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলব।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই, যেখানে ক্ষমতাসীন সরকার ধ্বংস করেনি, দলীয়করণ করেনি। সীমাহীন লুটপাট আর অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করা হয়েছে। একটা সময়ে শান্তিপূর্ণ জনতা ঘুরে দাঁড়ায় এবং গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে। সরকারের কোনো ভয়ভীতি আর নির্যাতন গণঅভ্যুত্থানকে ঠেকাতে পারবে না। জনগণ এখন জীবন দিতেও প্রস্তুত।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘিরে হঠাৎ করে পুরোনো ও নতুন গায়েবি মামলায় পুলিশ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করছে।
রাতের আঁধারে বিএনপির নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের অভিযোগের বিষয়ে গতকাল সাংবাদিকদের ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে অভিযানে নামেনি পুলিশ। এ ধরনের কোনো অভিযোগও নেই। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে দেখব। যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তারা সন্দেহভাজন বা নিয়মিত মামলার আসামি। অনেকে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি। আশুরা উপলক্ষে এটি ডিএমপির নিয়মিত অভিযান। ২০১৫ সালে তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা হয়েছিল। এটি আমাদের নিয়মিত অভিযানের অংশ, এটি চলবে।
আজ বিএনপির মহাসমাবেশের দিনে আওয়ামী লীগের তিন সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের ব্যানারে শান্তি সমাবেশ এবং রাজপথে সতর্ক পাহারা বসানোর ঘোষণা দিয়েছে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা বলছেন, বিএনপি শুক্রবারের মহাসমাবেশ কর্মসূচি ঘিরে ব্যাপক সহিংসতা-সন্ত্রাস ঘটাবে বলে শঙ্কা রয়েছে। আবার সরকারের ওপর চাপ বাড়ানো এবং বিদেশিদের কাছে জনসমর্থন দেখানোর লক্ষ্যেই বিএনপি হয়তো বা এই মহাসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে। বিএনপি সুযোগ পেলে সরকার পতনের দাবিতে রাস্তা অবরোধ বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করতে পারে বলেও সংশয় রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা অচল করার মতো পদক্ষেপও নিতে পারে তারা। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও এমন ইঙ্গিত দিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। এ কারণে রাজপথ নিজেদের দখলে রাখতেই তিন সহযোগী সংগঠনের শান্তি সমাবেশ ঘিরে বিশাল শোডাউনের প্রস্তুতি নিয়েছে ক্ষমতাসীনরাও।
ভেন্যু ঘিরে নানা নাটকীয়তার পর গতকাল বিকেলে মিন্টো রোডের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক জানান, অভিন্ন ২৩ শর্তে দুই দলকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সমাবেশে রাষ্ট্রদ্রোহী কোনো বক্তব্য দেওয়া যাবে না বলে সতর্ক করেন তিনি। সমাবেশে ব্যাগ, লাঠিসোটা নিয়ে না আসার অনুরোধ করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, দু’দলের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয়, এমন কোনো কাজ কেউ করবেন না। স্বেচ্ছাসেবকদের দিয়ে পুলিশকে সহায়তা করবেন।
বড় দু’দলকে একই দিনে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকিগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে, নাকি ‘সহানুভূতিশীল হয়েই’ তাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে– জানতে চাইলে খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, আমাদের কাছে এ মুহূর্তে বড় কোনো থ্রেট নেই। যেহেতু বড় দুটি দলের বড় সমাবেশ, তাই যে কোনো কুচক্রী মহল বা যে কেউ এই সমাবেশের সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে পারে।