স্ত্রীকে হত্যা করে জ্বিনের নাটক : অবশেষে ধরা
১২ অগাস্ট ২০২৩, ১৪:৩২ পিএম
স্কুলছাত্রী সাথী খাতুনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল প্রতিবেশী কিশোর আতিকুর রহমান আতিকের। বছরখানেক পর মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান স্বজনরা। স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর চিকিৎসক জানান, সে সন্তানসম্ভবা। পারিবারিক সালিশ বৈঠকে দু’জনই অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর কথা স্বীকার করলে বিয়ের সিদ্ধান্ত হয়। বিয়ের মাসখানেক পর রহস্যজনক মৃত্যু হয় সাথীর।
শ্বশুরবাড়ির লোকজন দাবি করে, তেলের পিঠা খাওয়ায় তার ওপর ‘জিনের আছর’ পড়ে এবং জিনই তাকে মেরেছে। এটা প্রচার করা হলেও অনেকেই তা বিশ্বাস করেনি। এ ঘটনায় মামলা হয়। শেষ পর্যন্ত তদন্তে বেরিয়ে আসে– স্বামীর হাতেই খুন হয় সাথী। দুই বছর আগে সিরাজগঞ্জ সদরের এ ঘটনায় সম্প্রতি চারজনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
পিবিআই সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার রেজাউল করিম বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে সাথীর মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে আলামত নষ্ট করে ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালায় আসামিরা। তবে সেই চেষ্টা সফল হয়নি। স্থানীয় লোকজন প্রথমে সন্দেহ করেছে, পরে থানা পুলিশের তদন্তেও বিষয়টি উঠে আসে। সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের সহযোগী আতিকের ভাই আরিফুল ইসলাম আরিফকে শনাক্ত করে পিবিআই এবং তার নাম অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করে।
তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, সিরাজগঞ্জ সদরের গজারিয়ায় পরিবারের সঙ্গে থাকত সাথী। ঘটনার সময় সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। দশম শ্রেণির ছাত্র আতিক ছিল তার প্রতিবেশী এবং সম্পর্কে ভাতিজা। সে প্রায়ই সাথীদের বাসায় টেলিভিশন দেখতে যেত। এই সুবাদে দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে ২০২১ সালের ১৩ জুন দুই পরিবারের সিদ্ধান্তে তাদের বিয়ে দেয়।
এদিকে পরিবারের চাপে বিয়ে করলেও আতিকের এতে মত ছিল না। গ্রেপ্তারের পর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সে উল্লেখ করে, বিয়ের পর বাইরে গেলেই লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করত। বিয়ের আগেই স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কটূক্তি করত। এতে সে প্রচণ্ড বিরক্ত হতো এবং স্ত্রীকে দেখলেই তার রাগ হতো। আতিকের মনে হতে থাকে– বিয়ে করে জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। এক পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়, স্ত্রীকে হত্যা করবে। ওই বছরের ১৮ জুলাই রাতে গলা টিপে শ্বাসরোধে সাথীকে হত্যা করে আতিক।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই সিরাজগঞ্জের এসআই ইমরান হোছাইন জানান, অপরাধ স্বীকার করলেও হত্যাকাণ্ডের সহযোগী আপন ভাই আরিফের কথা বেমালুম চেপে যায় আতিক। পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে আরিফ জানায়, আতিক যখন স্ত্রীর শ্বাসরোধ করে, সে তখন মেয়েটির দুই পা চেপে ধরেছিল। এর আগে সাথীকে হত্যার জন্য তাকে ডেকে নেয় আতিক। পরে তাদের মা-বাবা ঘরে ঢুকে পুত্রবধূর মরদেহ দেখতে পান। ঘটনার আলামত লুকাতে তারা সাথীর মলমূত্র লেগে থাকা বিছানার চাদরটি ধুয়ে ফেলেন। এর পর তারা ‘জিন সাথীকে মেরেছে’ বলে প্রচার চালান। পরে খবর পেয়ে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে।
মামলার বাদী সাথীর বাবা সাগর আলী মুন্সী জানান, তাঁর মেয়ের হত্যাকারীদের মধ্যে আরিফের নাম বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র দিয়েছিল থানা পুলিশ। এ কারণে তিনি নারাজি দেন। পরে আরিফসহ চারজনকে হত্যায় অভিযুক্ত করে পিবিআই। অন্য তিনজন হলো– আতিক, তাঁর মা মাজেদা খাতুন ও বাবা মো. কামরুজ্জামান।
ঘটনার সময় আতিক ও আরিফের বয়স ১৮ বছরের কম থাকায়, তাদের ‘আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়ানো শিশু’ হিসেবে উল্লেখ করে আলাদা অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অন্যদিকে হত্যার আলামত নষ্ট ও ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার অপরাধে তাদের মা-বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছে পিবিআই।