ইউরোপে থেকেও জঙ্গিবাদে জড়ান এবং দাওয়াতি কাজ চালাতেন
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২৩:২৮ পিএম
উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপে গিয়ে গ্রিনকার্ডে পরিবারসহ স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন মেজবাহ ওরফে আবু মাসরুর। একপর্যায়ে আরেক ইউরোপ প্রবাসী আশিক ওরফে আবু আফিফার মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে জড়িয়ে যান নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন ‘আনসার আল ইসলামে'।
বিদেশে অবস্থানকালে অনেককেই উদ্বুদ্ধ করে সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ অব্যাহত রাখেন মেজবাহ। ২০২২ সালের অক্টোবরে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে বাংলাদেশে এসে সংগঠনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে সংগঠনের ঢাকা অঞ্চলের দাওয়াতি শাখার দায়িত্ব পান।
সোমবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মেজবাহসহ আনসার আল ইসলামের ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা প্রত্যেকেই উচ্চশিক্ষিত, ইউরোপে উচ্চশিক্ষা নেওয়া ২ জনসহ রয়েছেন চিকিৎসকও।
গ্রেফতাররা হলেন, মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ওরফে আবু মাসরুর (৫০), শেখ আশিকুর রহমান ওরফে আবু আফিফা (৪৯), সাদী মো. জূলকার নাইন (৩৫), মো. কামরুল হাসান সাব্বির (৪০), মো. মাসুম রানা ওরফে মাসুম বিল্লাহ (২৬) ও সাঈদ মো. রিজভী (৩৫)।
ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) যৌথ অভিযানে রাজধানীর উত্তরা, বনানী, বনশ্রী ও যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ২টি ল্যাপটপ, ৬টি মোবাইল ফোন, উগ্রবাদে সহায়ক পুস্তিকা ও সাংগঠনিক কার্যক্রম সংক্রান্ত ডায়েরি ও নোট বই উদ্ধার করা হয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে আল কায়েদা মতাদর্শের জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। তারা বিভিন্ন সময় অনলাইনে নেতাদের বক্তব্য দেখেও উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয় এবং সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে যোগদান করে। পরবর্তীতে তারা সংগঠনের সদস্য সংগ্রহে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। বিভিন্ন দেশে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের কথা বলে ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে তথাকথিত জিহাদের নামে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী করে তুলতো তারা।
এ উদ্দেশ্যে সংগঠনের সদস্যদের তারা বিভিন্ন উগ্রবাদী বই, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সরবরাহ করতো। এছাড়াও তারা সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভুল তথ্য প্রদান করে তাদের আত্মীয়-স্বজন, বিভিন্ন মাদরাসা ও সদস্যদের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ সংগ্রহ করতো।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, তারা বিভিন্ন সময়ে মসজিদ, বাসা বা বিভিন্ন স্থানে সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা পরিচালনা করতো। বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতো এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন উগ্রবাদী গ্রুপে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার মিজবাহ ওরফে আবু মাসরুর দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য ২০০৪ সালে ইউরোপের একটি দেশে যান এবং ফিন্যান্স এ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন।
২০১০ সালে গ্রিনকার্ড স্কীমের মাধ্যমে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে সপরিবারে ইউরোপে একটি দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি আশিক ওরফে আবু আফিফার মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আনসার আল ইসলামে যোগদান করেন এবং দাওয়াতি কার্যক্রম শুরু করেন। মিজবাহ ওরফে আবু মাসরুর ইউরোপে অবস্থানের সময় সংগঠনের নাম না বলে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করে নতুন সদস্য সংগ্রহ করতেন এবং নতুন সদস্যদের নিয়ে গোপন সভা করে উগ্রবাদে আগ্রহী করতেন।
তিনি বলেন, ২০২২ সালের অক্টোবরে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে বাংলাদেশে এসে সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রম করতে থাকেন। তিনি ঢাকা, ঠাকুরগাও, দিনাজপুর, লক্ষীপুর, ভোলা এবং খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর, সভায় অংশগ্রহণ এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ ও চাঁদা আদায় করতেন।
গ্রেফতার শেখ আশিকুর রহমান ওরফে আবু আফিফা একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএস সম্পন্ন করেন। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরির পাশাপাশি এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবসাও করতেন। আশিকুর স্বপরিবারে ইউরোপের একটি দেশে বসবাসকালীন মিজবাহর সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
তিনি ইউরোপে থাকাকালীন সংগঠনের একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতার মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনে যোগদান করে দাওয়াতি কার্যক্রম করতে থাকেন। তিনি সংগঠনটির ঢাকা অঞ্চলের অন্যতম উপদেষ্টা ও অর্থের যোগানদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বিভিন্ন সময় উগ্রবাদী ভিডিও কনটেন্ট সংগঠনের সদস্যদের পাঠাতেন।
গ্রেফতার সাদী মো. জূলকার নাইন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে গার্মেন্টস সেক্টরে চাকরি করতেন। মিজবাহর মাধ্যমে আনসার আল ইসলামে যুক্ত হন এবং ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন দাওয়াতি কার্যক্রমের পাশাপাশি সংগঠনের নতুন সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন। সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান করতেন।
এছাড়া মেজবাহর কাছ থেকে বিভিন্ন উগ্রবাদী বই, মুসলমানদের ওপর নির্যাতন ও উগ্রবাদী নেতাদের বক্তব্যের ভিডিও সংগ্রহ করতেন। বিভিন্ন দেশের সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচিত হয়ে যোগাযোগ করে তথাকথিত জিহাদের নামে হিযরত করে পার্শ্ববর্তী দেশে গমনের পরিকল্পনা ও চেষ্টা করছিলেন।
গ্রেফতার কামরুল হাসান সাব্বির একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে আইটিতে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করে একটি আইটি ফার্মে কর্মরত ছিলেন। শেখ আশিকুর রহমানের মাধ্যমে সংগঠনে যুক্ত হন এবং নিয়মিত চাঁদা প্রদান করতেন বলে জানা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন উগ্রবাদী কনটেন্ট প্রচার করতেন এবং সংগঠনের নতুন সদস্যদের আইটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন।
গ্রেফতার সাঈদ মো. রিজভী পেশায় একজন চিকিৎসক। ২০২১ সালে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে অবস্থানকালীন উগ্রবাদী মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন। পরবর্তীতে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেজবাহর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তার মাধ্যমে সংগঠনে যোগ দেন এবং সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান করতেন। তার বাসায় প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর সংগঠনের সভা অনুষ্ঠিত হতো এবং নতুন সদস্যদের সংগঠনে যুক্ত করার আনুষ্ঠানিকতাও সেখানে সম্পন্ন হতো। এছাড়াও তার বাসায় সংগঠনের নতুন সদস্যদের শারীরিক কসরত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হতো বলে জানা যায়।
গ্রেফতার মাসুম রানা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত। সাদী জূলকার নাইনের মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হন। তার নিজ এলাকায় দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন বলে জানা যায়। সংগঠনে নিয়মিত চাঁদা প্রদান এবং সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করতেন। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।