স্কুলে জামাতের কার্যক্রম করতে না দেয়ায় নাস্তিক আখ্যা : প্রধান শিক্ষক কারাগারে

Anweshan Desk

Anweshan Desk

২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ২১:২৭ পিএম


স্কুলে জামাতের কার্যক্রম করতে না দেয়ায় নাস্তিক আখ্যা : প্রধান শিক্ষক কারাগারে

ষড়যন্ত্রের শিকার প্রধান শিক্ষক আবু সালেহ

কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে জামাতের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে ধর্মানুভূতিতে  আঘাতের গুজব ছড়ানো হয় এবং সাধারণ ধর্মপ্রাণ জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে তার বিরুদ্ধে জনসমাবেশ করে। এরপর তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং পুলিশ ওই প্রধান শিক্ষককে পুলিশ অনতিবিলম্বে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতার আবু সালেহ কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামের আব্দুল জব্বার শেখের ছেলে এবং কয়া চাইল্ড হ্যাভেন নিন্ম মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক।

তবে, ওই স্কুলের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীবৃন্দের  সাথে কথা বলে জানা যায় তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।

ওই স্কুলের একজন শিক্ষিকা লাবণী আক্তার বলেন, গত ২০ তারিখ ক্লাস চলাকালীন সময় আমাদের স্কুলে ৩ জন মহিলা আসেন। তাদের ৩ জনের আমরা মুখ চিনি তবে ২জনকে খুব ভালোভাবে চিনি। একজন হচ্ছে আমাদের স্কুলের পাশে যে ত্রিমোহনী মোড় ওটার পাশেই বাড়ি এবং সে কয়া সরকারি গার্লসের টিচার। তারা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের সহযোগী সদস্য ফরম এবং তাদের প্রচারণার লিফলেটসহ আসে। এরপর তারা  অফিসে ঢুকে এবং ইসলাম সম্পর্কে প্রধান শিক্ষিকা নিলুফা ম্যাডামের সাথে কথা বলে স্কুলের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সদস্য করতে চায়।

কিন্তু নিলুফা ম্যাডাম তাতে অসম্মতি জানালে তারা স্কুলে একটি ইসলামিক প্রোগ্রাম করার অনুমতি চায়। তখন ম্যাডাম প্রধান শিক্ষকের নিষেধ আছে বললে তারা বাকবিতণ্ডা শুরু করে। একপর্যায়ে তারা বলে, আপনাদের প্রতিষ্ঠান ও প্রধান শিক্ষককে দেখে নিবো, সাথে আপনাদেরও দেখে নিবো। এই বলে রাগান্বিত হয়ে তারা চলে যায়।

এরপরই তারা স্যারের নামে মিথ্যা অপবাদ দেয় এবং এলাকার হুজুরদের মাধ্যমে এগুলো ছড়িয়ে দিয়ে মানুষকে স্যারের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ করে তোলে। তারা ফেসবুক স্যার এবং স্কুলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়।

২২ তারিখে স্কুলে এসে দেখি স্কুলের শহীদ মিনার ভাঙা, অফিসে ভাঙচুর, স্যারের ছবি এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত ব্যানার নষ্ট করা হয়েছে।

স্কুলের সহকারী শিক্ষক আখির উদ্দিন বলেন,ওদিন জামায়াতে ইসলামের তিনজন মহিলা কর্মী এসেছিলেন। তারা অফিসে এসে প্রধান শিক্ষিকাকে কিছুটা জোরপূর্বক অর্থাৎ  নাম বয়স এবং জিজ্ঞেস করে তারা নিজেরাই ফর্ম পূরণ করে। এরপর শিক্ষার্থী এবং মহিলা শিক্ষকদের সদস্য বানাতে ক্লাসে মাহফিল করতে চায়। তারা বলে যে এখন পুরুষ শিক্ষকদের বের করে দিতে। কিন্তু নিলুফা ম্যাডাম তাতে অসম্মতি জানালে ক্ষুব্ধ হয়ে হুমকি দিয়ে চলে যায়৷ প্রধান শিক্ষকের সাথে ওই মহিলাদের কোন কথাই হয়নি।

স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা এবং প্রধান শিক্ষকের স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, সোমবার তারা স্কুলে এসে সদস্য কর্মী তৈরি করার জন্য স্কুলে ক্লাস চলাকালীন সময়ে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষািকাদের নিয়ে মাহফিল করতে চায়। আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি হইনি বলে তারা আমার স্বামীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে।

তিনি আরও বলেন, স্কুলটিতে জামায়াতের ঘাঁটি করতে দিইনি বলেই ওরা আমাকে শায়েস্তা করার জন্য আমার স্বামীর নামে মামলা দিয়েছে। ওরা এমনটি করবে তা আগে জানলে আমি এসব ঝামেলার মধ্যেই যেতাম না। ওদের দাবি মেনে নিলে আজকে হয়ত এই হয়রানিতে পড়তাম না।

দশম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী মোছা. বৈশাখী খাতুন বলেন, স্কুলে বোরকা পরার জন্য কোন বাধা সৃষ্টি করা হয়নি। আমি নিজেও বোরকা পরি। স্যার শুধু বলেছেন স্কুলের ড্রেসের কালারের সাথে ম্যাচ করে বোরকা বানাতে। স্যারের বিরুদ্ধে যা বলা হচ্ছে এগুলো সবই সাজানো ষড়যন্ত্র।

এছাড়া ওই স্কুলের ৮ম শ্রেনীর ছাত্রী তন্নি খাতুন ও ১০ম শ্রেনীর ছাত্রী আফরোজা খানমসহ কয়েজন শিক্ষার্থীর সাথে ঘটনার সত্যতা নিয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, বছররের শুরুতে এখনও আমাদের সকলের স্কুল ড্রেসকোড করতে পারেনি। সে বিষয়ে হেড স্যার আমাদের এ্যাসেম্বলির সময় বলেছেন, "তোমরা যারা স্কুল ড্রেস তৈরী করতে পারোনি তারা দ্রুত স্কুল ড্রেস করে নিও, যারা বোরখা পড়তে চাও তারা স্কুল ড্রেসের কালার ম্যাচিং বোরখা তৈরী করে নিবা, যাদের বাড়ি দূরে তারা এবং সরকারী সাইকেল যারা পেয়েছো তারা সবাই সাইকেল চড়ে স্কুলে আসবা।" স্যার কোনদিনই আমাদের বোরখা পড়তে নিষেধ করেনি।

স্কুলের দাতা সদস্য আবুল কাশেম বলেন, প্রায় দুই দশক ধরে বিনা পয়সায় বেকার খাটার পর গত জানুয়ারিতে স্কুলটি এমপিওভুক্তির চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। এরপর থেকেই এই স্কুলটিতে দখলবাজি করতে একটি চক্র নানা অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২০ তারিখ স্কুলে জামাত ইসলামের ৩ জন মহিলা আসে স্কুলে কর্মী তৈরি করতে। তারা হলো: আঁখি, স্বপ্না খাতুন এবং মুকুলের স্ত্রী। তারা স্কুলের ক্লাস বন্ধ করে মাহফিলের নামে জামাতের কার্যক্রম চালাতে চায়। তাদের অনুমতি না দেয়ায় রাগান্বিত হয়ে চলে যায় এবং প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে  আজগুবি কথাবার্তা ছড়ায়৷

এদিকে যেই মহিলাকে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে দেখা যায় তার কথার পক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ কিছুই নেই। যারা সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা কেউই সেখানে উপস্থিত ছিলেন না।

স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, শিক্ষক - শিক্ষিকা এবং শিক্ষার্থীবৃন্দের অন্যদের সাথে বলেও শিক্ষকের বিরুদ্ধে করা অভিযোগের সত্যতা মিলেনি। বরং তারা শিক্ষকের অনতিবিলম্বে মুক্তি এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।

কয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং কুষ্টিয়া জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল ইসলাম স্বপন বলেন, “(মঙ্গলবার) বিকালেই আমি ঘটনাটি শুনেছি। আমি নিজে সেখানে গিয়ে খোঁজ নিয়েছি এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি।

“তারা বলেছেন, গ্রেপ্তার শিক্ষকের স্ত্রী স্থানীয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নিলুফার ইয়াসমিন লিলিকে মহিলা জামায়াতের সদস্য করার জন্য কয়েকজন মহিলা ফরম দিয়ে আসেন। সেটি পূরণ করতে এবং ওই স্কুলে মহিলা জামায়াতের মাহফিল করতে চাপ দেন। তিনি রাজি না হওয়ায় স্পর্শকাতর বিষয়ে মামলা দিয়ে শায়েস্তা করতে চেয়েছে।”

এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে যুবলীগ নেতা জিয়াউল শিক্ষক আবু সালেহর মুক্তি দাবি করেন।

 

 

 


Link copied