গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের দায়িত্ব - প্রভাষ আমিন
৩০ মার্চ ২০২৩, ১৩:৩৫ পিএম
১৯৭৪ সালের ইত্তেফাক আর ২০২৩ সালের প্রথম আলো এক নয়। বাসন্তী আর জাকির হোসেনও এক নয়। অনেকেই দুটি ঘটনা মিলিয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন, যা একদমই ঠিক নয়। ৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের সময় কুড়িগ্রামের বাসন্তীর গায়ে জাল পরিয়ে ছবি তোলার ঘটনাটি সাংবাদিকতার মধ্যেই পড়ে না। সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার একটি বড় ষড়যন্ত্রের অংশ। সেটি সাংবাদিকতা নয়, অপসাংবাদিকতা নয়, সেটি স্পষ্টতই ষড়যন্ত্র।
প্রথম আলো ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে তাদের অনলাইনে যে ফটো স্টোরি করেছে, তা প্রথম ভুল সাংবাদিকতা, তারচেয়ে বড় কথা হলো সেটি উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতা। সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধের গেটের বাইরে দাঁড়ানো একটি শিশু স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে আছে। চমৎকার ফ্রেমের ছবিটি স্বাধীনতা দিবসে ছাপার জন্য দারুণ উপযোগী। কিন্তু গোল বাধে ছবির ক্যাপশন নিয়ে। ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলে স্বাধীনতা লাগব: জাকির হোসেন, দিনমজুর, সাভার।’
অনলাইনে ফটো স্টোরিটি প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই ঝড় ওঠে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অনুসন্ধানে নামে বিভিন্ন গণমাধ্যমও। প্রথম আলো ভুলটি বুঝতে পেরে ফটো স্টোরিটি প্রত্যাহার করে নেয়। পরে ভুল স্বীকার করে দুঃখও প্রকাশ করেছে। উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতায় পরে আসছি, আগে ভুলটা বলে নিই। প্রথম কথা হলো, ছবির শিশুটির নাম জাকির নয়, সবুজ। শিশুটি দিনমজুরও নয়। ৭ বছর বয়সী সবুজ স্থানীয় একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। স্কুল শেষে বিকালে স্মৃতিসৌধ এলাকায় ফুল বিক্রি করতে যায়। তার পরিবার দরিদ্র, তবে হতদরিদ্র নয়। পরিবারের অবস্থা যাই হোক, সবুজকে বাজারে গিয়ে ঘাম ছুটাতে হয় না। তাই এটি পুরোপুরি ভুল ছবি, ভুল ক্যাপশন। হতে পারে জাকির হোসেন নামের কোনও দিনমজুরের সঙ্গে সত্যিই কথা বলেছেন প্রথম আলোর সাংবাদিক। কিন্তু ভুলে জাকির হোসেনের জায়গায় সবুজের নাম ছাপা হয়েছে। এটুকু ভুল কিন্তু সাংবাদিকতায় গ্রহণযোগ্য।
ভুল বুঝে সেটি স্বীকার করে নিউজটি প্রত্যাহার করাতেই সব শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু সমস্যা হলো উদ্দেশ্যে। ভুল সাংবাদিকতার চেয়ে উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতা বেশি ভয়ংকর। একজন মানুষ যদি সত্যি সত্যিও বলেন, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’, সেটি স্বাধীনতা দিবসে আমি ছাপবো কিনা, সেটাই আমার সম্পাদকীয় মুন্সিয়ানা। প্রথম আলো তো আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়, সেখানে যা ইচ্ছা তা-ই ছাপা যায় না। দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দৈনিক প্রথম আলোর রয়েছে শক্তিশালী ডেস্ক। রিপোর্টার যাই লিখুক, আলোকচিত্র সাংবাদিক যত ভালো ছবিই তুলুন; কোনটা ছাপা হবে বা হবে না; সেটা তো তারা ঠিক করবেন না, সম্পাদকীয় বোর্ড ঠিক করবে। জাকির হোসেন হোক আর সবুজ মিয়া হোক, তারা যদি এই কথাটি বলেও থাকেন; স্বাধীনতা দিবসে এই কথা ছাপানোটা উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতা। এর মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে আমাদের মহান স্বাধীনতাকেই হেয় করা হয়েছে। অনেক দিন ধরেই একটি মহল বলার চেষ্টা করছে, আমাদের স্বাধীনতাটাই ভুল ছিল, পাকিস্তান আমলই ভালো ছিল।
প্রথম আলো বুঝে হোক না বুঝে হোক, সেই মহলের জন্য যুক্তি তৈরি করছে। সেই মহলটি এখন বলার চেষ্টা করবে, দেখো, দিনমজুররাও এখন স্বাধীনতা নিয়ে হতাশ। এটা ঠিক, অনেক দিন ধরেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। করোনা এবং যুদ্ধ মিলে শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই টালমাটাল। শুধু সাভারের একজন দিনমজুর নয়, বাংলাদেশের অনেক সচ্ছল মধ্যবিত্তেরও বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের পুষ্টিতে টান পড়েছে। নির্দিষ্ট কিছু খরচ কমানোর উপায় নেই বলে বাজারের খরচ কমাতে হয়েছে। তাতে মাছ-মাংস খাওয়ার হার কমে গেছে। অনেক পরিবার হয়তো মাছ-মাংসের দেখাই পান না। তাই বলে তো ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায় না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম দিনের পর দিন রিপোর্ট করেছে। সেসব রিপোর্টেও জাকির হোসেনের মতো দিনমজুরের দুর্দশার কথা উঠে এসেছে, বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যাওয়ার কথাও অনেকেই আগে-পরে বলেছেন। কারও কারও অবস্থা আরও খারাপ। অনেকের হয়তো বাজার পর্যন্ত যাওয়ারও সামর্থ্য নেই, চেয়ে-চিন্তে চলতে হয়। কিন্তু তাই বলে তো স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায় না।
পৃথিবীর কোনও স্বাধীন দেশেই সব মানুষের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়, এমন মানুষ আপনি আমেরিকাতেও পাবেন। পাকিস্তানের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ১৫৪৩ ডলার আর বাংলাদেশে ২৭৯৩ ডলার। পাকিস্তানের রিজার্ভ ৫৪৫ কোটি ডলার। আর অনেক কমেও বাংলাদেশের রিজার্ভ ৩১০০ কোটি ডলার। স্বাধীনতার পর অনেকেই ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকতেই পারবে না। বাংলাদেশ হবে তলাবিহীন ঝুড়ি। কিন্তু ৫২ বছরে বাংলাদেশ সবাইকে অবাক করে অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের বিস্ময়। এই সরকারের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আছে। গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার, সুশাসনের ঘাটতি, দুর্নীতি, অর্থপাচার- অভিযোগের অন্ত নেই। কিন্তু একটি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকা আর বাজার দরের সঙ্গে স্বাধীনতাকে মিলিয়ে ফেলাটা কোনও কাজের কথা নয়। একজন দিনমজুর যে মাছ, মাংস, চালের স্বাধীনতা চান; এটাও স্বাধীনতারই অর্জন। একসময় এই দেশে দুর্ভিক্ষ ছিল, মঙ্গা ছিল। এখন সেসব আমরা অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। একসময় মানুষ ‘দুবেলা দুমুঠো ভাত’ পেলেই খুশি ছিল। এখন মাছ-মাংসের স্বাধীনতা চায়।
ভুল হোক আর উদ্দেশ্যমূলক হোক, প্রথম আলোর এই সাংবাদিকতা আমাদের অনেক বিপদে ফেলবে। এমনিতেই বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তার মধ্যেও প্রথম আলো অনেক সাহসী সাংবাদিকতা করে আসছিল। আমরা যারা ভীতু, তারা প্রথম আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু সেই প্রথম আলোই যখন উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতা দিয়ে সাংবাদিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে, তখন আমরা অসহায় বোধ করি। সরকারের বিরোধিতা আর দেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা এক নয়।
প্রথম আলো ভুল করেছে, কিন্তু সরকার সেই ভুলের জবাব দিয়েছে আরও বড় ভুল দিয়ে। বুধবার ভোরে প্রথম আলোর সাভারের স্টাফ রিপোর্টার শামসুজ্জামানকে তার বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। যখন তাকে তুলে নেওয়া হয়, তখনও তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না, কোনও মামলা ছিল না। কোনও মামলা ছাড়া, অভিযোগ ছাড়া একজন সাংবাদিককে ভোর রাতে তুলে নেওয়ার সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যায় না। সাভারের বাসা থেকে তুলে আনার কয়েক ঘণ্টা পর বুধবার দুপুরে তার বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় মামলা হয়েছে। মামলা হলেও একজন সাংবাদিককে তার সাংবাদিকতার জন্য গ্রেফতার করা যায় না। সেখানে শামসুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়েছে মামলা ছাড়াই। প্রথম আলোর ভুল সাংবাদিকতায় সরকার যতটুকু সহানুভূতি পেয়েছিল, তা বোধহয় তাদের পছন্দ হচ্ছিল না। শামসুজ্জামানকে গ্রেফতার করে দ্রুতই তা মিলিয়ে যেতে সহায়তা করেছে সরকার। ভুল সাংবাদিকতা বা উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতায় প্রথম আলোর ভাবমূর্তি যতটা ক্ষুণ্ন হয়েছিল, তারা যতটা সংকটে পড়েছিল, শামসুজ্জামানকে গ্রেফতার করে সরকার দ্রুতই তা পুনরুদ্ধার করে দিলো।
সাংবাদিকতা, অপসাংবাদিকতা, ভুল সাংবাদিকতা, উদ্দেশ্যমূলক সাংবাদিকতা, গণমাধ্যমের দায়, গণমাধ্যমের দায়িত্ব নিয়ে আমরা অবশ্যই কথা বলবো। তার আগে আরও বেশি করে কথা বলতে হবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে। একটি ছবি আর তার ভুল ক্যাপশনের জন্য ভোর রাতে একজন সাংবাদিককে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই।
লেখক - প্রভাষ আমিন ( হেড অব নিউজ, এটিএন)